স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ব্যাপক তদবির বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। একইসঙ্গে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (ছাত্র প্রতিনিধি) তুহিন ফারাবি ও ডা. মাহমুদুল হাসানের বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগের তীর উঠেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর অনুযায়ী, এই প্রভাবশালী কর্মকর্তারা বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বদলি ও ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দেওয়ার মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, মোয়াজ্জেম হোসেন স্থানীয় সরকার, স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, পানিসম্পদ, গণপূর্ত এবং সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নিয়মিতভাবে তদবির করতেন। বিশেষ করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে (এলজিইডি) প্রধান প্রকৌশলী থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায়ের প্রকৌশলীদের বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও, স্বরাষ্ট্র, পানিসম্পদ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদপ্তর এবং সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগে ঠিকাদারদের কাজ বাগিয়ে দিতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন বলে জানা গেছে। এমনকি পুলিশের অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেনাকাটাতেও তিনি ঠিকাদারদের বিল পাইয়ে দেওয়ার জন্য তদবির করতেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে মোয়াজ্জেমের প্রভাব ছিল ব্যাপক। অভিযোগ রয়েছে, বিগত সরকারের আমলে যেসব ঠিকাদার কাজ ফেলে পালিয়েছিলেন, তাদের কাজ নতুন ঠিকাদারদের দিয়ে শুরু করানোর বিনিময়ে তিনি বড় অঙ্কের কমিশন আদায় করতেন। গণপূর্ত অধিদপ্তরে প্রকৌশলীদের বদলির ক্ষেত্রেও তার বিরুদ্ধে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। সন্ধ্যা হলেই তিনি সেগুনবাগিচায় গণপূর্ত অধিদপ্তরে গিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহর এবং ঢাকার নিকটবর্তী জেলাগুলোতে প্রকৌশলীদের বদলির তালিকা তৈরি করতেন বলে জানা যায়। প্রতিটি বদলির জন্য তিনি লক্ষ লক্ষ টাকা নিতেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা নিয়োগ ও বদলির ক্ষেত্রেও মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে তদবির বাণিজ্যের অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। শুধু তাই নয়, ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে চিহ্নিত প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের পুনর্বাসনে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করতেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (ছাত্র প্রতিনিধি) তুহিন ফারাবি ও ডা. মাহমুদুল হাসানের বিরুদ্ধেও একই ধরনের আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত এই দুজন চিকিৎসক, মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল, পরিচালক, উপপরিচালক ও সিভিল সার্জন নিয়োগ ও বদলির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিটি নিয়োগ ও বদলির জন্য ১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে নতুন সচিব নিয়োগের পর তারা তাকে প্রভাবিত করে বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক ও কর্মচারীর বদলি করিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এমনকি সিনিয়র স্টাফ নার্স ও মিডওয়াইফ বদলিতেও তারা জনপ্রতি দুই লাখ টাকা করে নিতেন বলে জানা গেছে। হজ টিমে নার্স ও ডাক্তারদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্যও তারা অর্থ আদায় করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে, গত বছরের ৮ আগস্টের পর তুহিন ফারাবি ও ডা. মাহমুদুল হাসান সাবেক স্বাস্থ্য সচিবের মাধ্যমে বেশ কয়েকজন চিকিৎসককে বদলি করান এবং প্রতিটি বদলির জন্য ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা করে নেন বলে অভিযোগ। এছাড়াও, ৫ আগস্টের পর পালিয়ে যাওয়া ঠিকাদারদের স্থলে নতুন ঠিকাদার নিয়োগের ক্ষেত্রেও তারা কমিশন বাণিজ্য করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
তদবির বাণিজ্যের অভিযোগ সামনে আসার পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে মোয়াজ্জেম হোসেন এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে তুহিন ফারাবিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। গত ২১ এপ্রিল এই সংক্রান্ত সরকারি আদেশ জারি করা হয়। তবে অভিযুক্ত ডা. মাহমুদুল হাসান বর্তমানে রাশিয়ায় অবস্থান করছেন এবং তিনি আদৌ দেশে ফিরবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, মাহমুদ আগে থেকেই রাশিয়ায় বসবাস করতেন এবং গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর তিনি দেশে ফেরেন। তখন তুহিন ফারাবি তাকে মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ পাইয়ে দেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মো. মোয়াজ্জেম হোসেন দাবি করেন, তাকে অপসারণ করা হয়নি, বরং তিনি ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করেছেন। আগামী মাসে তার পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মৌখিক পরীক্ষা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি ভাইভা পরীক্ষা রয়েছে বলে তিনি জানান। তার বিরুদ্ধে চারশ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "আমি এক টাকার দুর্নীতি করেছি কেউ তা প্রমাণ করতে পারবেন না।"
অন্যদিকে, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের সাবেক ব্যক্তিগত কর্মকর্তা তুহিন ফারাবি এবং বর্তমান ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মো. মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের অফিসে পাওয়া যায়নি। তুহিন ফারাবিকে ইতোমধ্যে অপসারণ করা হয়েছে এবং মাহমুদুল হাসান বর্তমানে রাশিয়ায় এক রোগীর সঙ্গে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। তাদের হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠানো হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি এবং তাদের ফোনও বন্ধ রয়েছে।
এই ঘটনা সরকারি মহলে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো বিষয়টির তদন্ত করছে বলে জানা গেছে।
সূত্র: যুগান্তর।