নির্বাচনের আগে-পরে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভুয়া মন্তব্য, হাজারো বট অ্যাকাউন্টের সন্ধান!
২০২৪ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে আওয়ামী লীগের পক্ষে বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং বিরোধী দলের ফেসবুক পেজে অসংখ্য মন্তব্য করা হয়েছিল। সম্প্রতি একটি গবেষণায় জানা গেছে, এই মন্তব্যগুলো মানুষের দ্বারা পরিচালিত হয়নি, বরং ভুয়া বা নকল প্রোফাইলগুলো বট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে।
ডিসমিসল্যাব নামক একটি সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত গবেষণায় ১,৩৬৯টি ফেসবুক প্রোফাইলের একটি বট নেটওয়ার্কের সন্ধান পাওয়া গেছে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, এই প্রোফাইলগুলো থেকে আওয়ামী লীগের পক্ষে ১৯৭টি পোস্টে ২১,০০০-এর বেশি সমন্বিত মন্তব্য করা হয়েছে। বিভিন্ন পোস্টে একই মন্তব্য বিভিন্ন প্রোফাইল থেকে করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, বট অ্যাকাউন্ট এবং এর মন্তব্যের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
বট নেটওয়ার্ক হলো একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা, যেখানে বিশেষ সফটওয়্যারের (বট) মাধ্যমে কাজ করা হয়। এর কার্যক্রম আংশিকভাবে কম্পিউটারভিত্তিক বা স্বয়ংক্রিয়। এই প্রক্রিয়ায় একটি তালিকা থেকে নির্দিষ্ট 'কি-ওয়ার্ড' বা শব্দ ধরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পোস্ট বাছাই করা হয়। এরপর অন্য একটি তালিকা থেকে মন্তব্য বেছে নিয়ে পোস্ট করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় মন্তব্যগুলো কোথায় পোস্ট করা হচ্ছে, সেদিকে মানুষের নজরদারি প্রায় থাকে না বললেই চলে।
গবেষণায় দেখা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে, ৭ জানুয়ারি বট নেটওয়ার্কটি সক্রিয় হয়। জুন মাস পর্যন্ত বট নেটওয়ার্কটি ৪৭৪টি একই ধরনের রাজনৈতিক মন্তব্য ঘুরেফিরে পোস্ট করেছে। মন্তব্যগুলো নির্বাচনের আগে তৈরি করা হলেও, নির্বাচনের পরেও একই মন্তব্য পোস্ট করা হয়েছে। বট নেটওয়ার্কটি দেশের প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম এবং তৎকালীন বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফেসবুক পেজকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে।
গবেষণায় নকল প্রোফাইলগুলোর মধ্যে একধরনের সংযোগের চিত্রও পাওয়া গেছে। মূলত দুটি নির্দিষ্ট পেজে লাইক দেওয়ার প্রবণতা থেকে এই চিত্রটি সামনে এসেছে। প্রোফাইল 'লকড' করা নেই, এমন ১,১২৪টি অ্যাকাউন্টের ৭০ শতাংশ 'বাংলার খবর' এবং 'আওয়ামী লীগ মিডিয়া সেল' নামের পেজ দুটির কোনো একটিকে বা দুটিকেই অনুসরণ করেছে। তবে, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে 'আওয়ামী লীগ মিডিয়া সেল' পেজটি আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
যেভাবে বট নেটওয়ার্কের খোঁজ মিলল:
২১ জুন, একটি অনলাইন গণমাধ্যমের ওয়েবসাইটে 'কালার প্রিন্টারে ছাপানো প্রতিটি পৃষ্ঠায় থাকে অদৃশ্য কোড?' শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদটি তাদের ফেসবুক পেজেও শেয়ার করা হয়। উভয় পোস্টে একটি মন্তব্য দেখা যায়: "এবারের নির্বাচন স্বচ্ছ হবে। আগামী নির্বাচনে জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে। আর এবার ভোট চুরি করতে পারবে না বলেই বিএনপি নির্বাচনে আসতে ভয় পাচ্ছে এবং এত কাহিনী করছে।"
নির্বাচনের প্রায় ছয় মাস পরেও 'ব্যবহারকারীরা' এই পোস্টের নিচে বিএনপির সমালোচনা, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সফল ও সুষ্ঠুভাবে হওয়ার আশাবাদ, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের দাবি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক বিষয়ে একের পর এক মন্তব্য করে। এই মন্তব্যগুলোর কারণ খুঁজতে গিয়ে ডিসমিসল্যাব ১,৩৬৯টি ফেসবুক অ্যাকাউন্টের একটি বট নেটওয়ার্কের সন্ধান পায়।
গবেষণার জন্য গণমাধ্যমটির ফেসবুক পোস্ট থেকে প্রতিটি মন্তব্য সংগ্রহ করে ডিসমিসল্যাব। সেই তালিকা ধরে গুগল সার্চ দিয়ে একই মন্তব্যযুক্ত আরও ১৯৬টি পোস্ট বের করা হয়। এই পোস্টগুলো থেকে প্রতিটি মন্তব্য সংগ্রহ করে ৩৫,০০০ মন্তব্যের একটি ডেটাবেস তৈরি করা হয়। এই ডেটাবেস থেকে বট অ্যাকাউন্ট এবং এর করা ২১,০০০-এর বেশি রাজনৈতিক মন্তব্য আলাদা করা হয়।
রাজনৈতিক পোস্টে বট নেটওয়ার্কের আগ্রাসন, ভুল পথে 'ইসি' মন্তব্য!
গবেষণায় দেখা গেছে, বট নেটওয়ার্কটি সাধারণত রাজনৈতিক পোস্টেই মন্তব্য করে। ফেসবুক পোস্টে নির্দিষ্ট কিছু রাজনৈতিক 'কি-ওয়ার্ড' বা শব্দ পেলে তারা সেই পোস্টে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তবে, মাঝে মাঝে তাদের ভুলও হয়। যেমনটি হয়েছে 'ইসি' (নির্বাচন কমিশন) শব্দের ক্ষেত্রে। একটি কালার প্রিন্টার-সংক্রান্ত খবরের সারাংশে 'মেশিন আইডেনটিফিকেশন কোড (এমআইসি)' এর উল্লেখ ছিল। সেখানে 'ইসি' শব্দাংশ দেখেই বট নেটওয়ার্কটি শ'খানেক মন্তব্য করে।
গবেষণার জন্য বাছাই করা 'বট' প্রোফাইলগুলোর মধ্যে ২৪৭টি 'লকড' অবস্থায় ছিল। বাকি ১,১২২টি অ্যাকাউন্টের মধ্যে ৭০ শতাংশের প্রোফাইল ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা। ছবিগুলো অন্যের। কোথাও কোথাও একই ছবি বিভিন্ন প্রোফাইলে ব্যবহার করা হয়েছে।
এছাড়া, এসব প্রোফাইলের ৭৭ শতাংশ নারীদের নামে। এসব নামেও অদ্ভুত মিল রয়েছে। নারীদের প্রোফাইলের ২৪ শতাংশের নাম 'আক্তার' দিয়ে শেষ হয়েছে। যেমন, দিয়া আক্তার, রিয়া আক্তার, লিজা আক্তার, লিমা আক্তার, লিসা আক্তার ইত্যাদি। আর পুরুষদের প্রোফাইলগুলোর একটি বড় অংশের শেষ নাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে 'আহমেদ'। যেমন, নাঈম আহমেদ, নাদিম আহমেদ, কামিল আহমেদ, মাহিন আহমেদ, সামির আহমেদ ইত্যাদি। নারী-পুরুষ উভয় ধরনের প্রোফাইলের ৯০ শতাংশ নামই দুই শব্দের। কিছু ক্ষেত্রে একটি নামকে ভেঙে দুই শব্দ করা হয়েছে। যেমন, রি পা, মি না, লি জা, যু থি, লাম ইয়া, মু না, নে হা, জোস না ইত্যাদি।
গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নকল প্রোফাইলগুলো মূলত গত বছরের জুন থেকে নভেম্বরের মধ্যে সক্রিয় হয়েছে। নকল প্রোফাইলগুলোর অর্ধেকই সক্রিয় হয়ে ওঠে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে। শুধু নভেম্বরের ২৩ থেকে ৩০ তারিখের মধ্যে প্রথমবারের মতো পোস্ট করে ৩৪৪টি অ্যাকাউন্ট। এর আগে ২ থেকে ১২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ২৪০টি প্রোফাইল সক্রিয় হয়। আর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এ বছরের ৭ জানুয়ারি।
গবেষণায় পাওয়া ২১,২২১টি রাজনৈতিক মন্তব্যের মধ্যে ইউনিক ছিল মাত্র ৪৭৪টি। বটগুলো বিভিন্ন পোস্টে ঘুরে ফিরে এই ৪৭৪টি মন্তব্যই করেছে। বটগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ স্পষ্টভাবে দেখা যায়। যেমন, রিয়া আক্তার নামের একটি প্রোফাইল থেকে গত ছয় মাসে বিভিন্ন পোস্টে ১৩৮টি মন্তব্য করা হয়েছে। নির্বাচনের অনেক পরে ১৮ মে এই প্রোফাইল থেকে একটি মন্তব্য করা হয়।

নির্বাচনে বট নেটওয়ার্কের ছায়া, রাজনৈতিক পোস্টে নির্বিচারে মন্তব্য!
বিভিন্ন সময়ে মোট ৯৬টি পোস্টে একই মন্তব্য করা হয়েছে দিয়া আক্তার, রাইসা, রাফিয়া আক্তার, নাহিদ, নিপাসহ ১০৯টি বট প্রোফাইল থেকে। বট নেটওয়ার্কটি মূলত ৪২টি ফেসবুক পেজকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে। যার মধ্যে ৬৮ শতাংশ প্রথম সারির ও পরিচিত গণমাধ্যমের। এককভাবে ৩১ শতাংশ পেজ হলো বিএনপি বা বিএনপি-সংশ্লিষ্ট। এছাড়া, গণসংহতি আন্দোলনের পেজকেও লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে।
বট মন্তব্যগুলোর ৮৬ শতাংশেই বিএনপি ও দলটির নেতা-নেত্রীদের সমালোচনা বা তাদের প্রতি আক্রমণ করা হয়েছে। যেমন- 'আগুন-সন্ত্রাসী সংগঠন বিএনপি। এদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি' বা 'আত্মসাৎ, অর্থপাচার করে বাংলাদেশকে লুটপাট করার হাওয়া ভবন করার চক্রান্ত করছে বিএনপি'। বাকি ১৪ শতাংশ মন্তব্যের বিষয়বস্তু ছিল সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রশংসা এবং নির্বাচন শান্তিপূর্ণ বা সুষ্ঠু করার আহ্বান।
গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচন হলেও ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, মে বা জুন মাসেও বট প্রোফাইলগুলো থেকে 'আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন', 'দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে' জাতীয় কথা ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ, মন্তব্যগুলো নির্বাচনের আগে তৈরি করা। কিন্তু তা নির্বাচনের পরও নির্বিচারে পোস্ট করা হয়েছে।
বট প্রোফাইল থেকে অপ্রাসঙ্গিক পোস্টেও রাজনৈতিক মন্তব্য করা হয়েছে। এসব পোস্টের প্রতিটির বিবরণেই কোনো না কোনোভাবে 'ইসি' শব্দটি আছে। যেমন আইসিইউ, আইসিসি, রইসি, আইএফআইসি, ওআইসি, আইসিটি, ডায়ালাইসিস বা ক্রাইসিস। বট নেটওয়ার্কটি তার লক্ষ্যবস্তু পেজে যেখানেই 'ইসি' শব্দাংশ পেয়েছে, সেটি প্রাসঙ্গিক হোক আর না হোক, সেখানেই সমন্বিতভাবে রাজনৈতিক মন্তব্য করেছে। গবেষণায় বলা হয়, এটি ইঙ্গিত করে যে নেটওয়ার্কটি কোন পোস্টে মন্তব্য করবে, সেটি বাছাইয়ের জন্য কি-ওয়ার্ড-নির্ভর একটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের গবেষণা দেখাচ্ছে, বট নেটওয়ার্কের বিস্তার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও নির্ভুল তথ্যব্যবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। এ ধরনের নেটওয়ার্ক অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গিকে দমন করতে পারে। পাশাপাশি নির্দিষ্ট কিছু দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রচার করার মাধ্যমে জনসাধারণের আলোচনাকে বিকৃত করতে পারে। এই কারসাজি জনমতের মেরুকরণ করতে পারে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা নষ্ট করতে পারে।
বট নেটওয়ার্কটি কম্পিউটারভিত্তিক অপপ্রচারের একটি উদাহরণ বলে মন্তব্য করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের ফিলিপ মেরিল কলেজ অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইনফরমেশন স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক নাঈমুল হাসান। তিনি বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ ও কম্পিউটারভিত্তিক টুলের সাহায্যে সংঘবদ্ধভাবে মূলত এসব কাজ করা হচ্ছে।
নাঈমুল হাসান আরও বলেন, ভবিষ্যতে প্রযুক্তিগুলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ব্যবহার করে আরও উন্নত হবে। ফলে একই প্রোফাইল ছবি বিভিন্ন ভুয়া অ্যাকাউন্টে ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়বে না। এআই দিয়ে নিমেষেই অনেকগুলো প্রোফাইল ছবি তৈরি হয়ে যাবে, যাতে সংঘবদ্ধ অপপ্রচারমূলক আক্রমণগুলো চিহ্নিত করা কঠিন হয়। তাই এখন থেকেই বিষয়গুলো নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন।