বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতার সম্ভাবনা কতটুকু?

একসময় বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত বলতে মুদ্রার মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ ভাবা হতো। তারা বহু বছর ধরে জোট বেঁধে নির্বাচন করেছে। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদের চতুর্থ বছর ২০২২ সাল থেকে তাদের মধ্যে উত্তেজনা শুরু হয়। একই বছরের ডিসেম্বরে জামায়াতের সঙ্গে জোট ভেঙে যায় বিএনপির।

এরপর থেকে উভয় দলের কেন্দ্রীয় নেতারা একে অপরকে এড়িয়ে চলতে দেখা যায়। তারা সভা-সমাবেশে একে অপরের সমালোচনা করতেও দ্বিধা করেননি তারা।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ধারণা করা হচ্ছিল দুই দল পুনরায় জোটবদ্ধ হবে। একসঙ্গে নির্বাচনের পথে হাঁটবে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে অন্যরকম কথা। বিভিন্ন বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ২০ দলীয় জোট ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও জোটের শরিকরা যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেয়। আন্দোলনের শুরুতে একযোগে কর্মসূচি পালনকালে জামায়াত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিএনপি বিষয়টি ভালোভাবে নিতে পারেনি বিএনপি। এরপর অনেক দিন একযোগে আন্দোলন থেকে বিরত ছিল জামায়াত।

কেউ যদি বিকৃত করে বক্তব্য প্রচার করে তাহলে কি বলার আছে? বিএনপির সঙ্গে আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক। তবে চার বছর ধরে নিষ্ক্রিয় রয়েছে জোটটি। যাইহোক, এর অর্থ এই নয় যে সম্পর্ক এবং যোগাযোগের অভাব রয়েছে।

জামায়াতের আমির ড. শফিকুর রহমান

গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের ডাক দেয় বিএনপি ও তাদের জোটের যৌথ আন্দোলনে। একই দিন ঢাকায় সমাবেশের ঘোষণাও দিয়েছে জামায়াত। শুরুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি না দিলেও শেষ পর্যন্ত তারা মতিঝিল এলাকায় নিরাপদে সমাবেশ করে। কিন্তু ওই দিন বিএনপির সমাবেশে হামলা চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এরপর পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার শুরু করে। তখন জামায়াতের প্রতি সন্দেহ তৈরি হয়। কারণ সেদিন সরকার বিএনপিকে আক্রমণ করলেও জামায়াতকে সমাবেশ করে চলে যেতে দেয়।

কিন্তু সবকিছু ভুলেগত ২৬ জুলাই জামায়াতকে নিয়ে সরকার পতনের আন্দোলন সুসংহত করতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয় বিএনপি। কিন্তু আওয়ামী লীগের পতনের পর জামায়াত তাদের অবস্থান পাল্টে ফেলে। তারা আওয়ামী লীগের জন্য সাধারণ ক্ষমার কথা বলছেন। নির্বাচনী ইস্যুতে তিনি বিএনপির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এসব বিবেচনায় নিলে জামায়াতের সঙ্গে আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়া বিএনপির পক্ষে সম্ভব নয়। তাদের সঙ্গে একসঙ্গে নির্বাচন করার কোনো সম্ভাবনা নেই।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, “নির্বাচন ইস্যুতে জামায়াত উল্টাপাল্টা কথা বলছে। আমরা তো তাদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলিনি।’

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর - ছবি সংগৃহীত


তিনি বলেন, জামায়াত যখন অনেক কথা বলে তখন তো কিছু কথার জবাব দিতে হয়। জামায়াতের আমিরের একটি বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন আমাদের মহাসচিব। আগামী নির্বাচনে জামায়াত কীভাবে এবং কার সঙ্গে জোট করবে এটা তাূের ব্যাপার। আমাদের এখানে কিছু বলার নেই।"

সেলিমা রহমান বলেন, ‘নির্বাচনের অনেক দেরি আছে এখনো। সময় এলে আমরা কীভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব তা নিয়ে ভাবব।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতির উদ্দেশে ভাষণে যে প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির পক্ষ মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন।

জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান ফেনীতে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন: “শত শত মানুষ এখনও হাসপাতালের বিছানায় কাঁদছে।” রক্তের দাগ শুকায় নাই । বন্যার কবলে পড়েছে দেশ। এই সময়ে কেউ নির্বাচন নির্বাচন জিকির তুললে জাতি তা গ্রহণ করবে না।’

জামায়াতের আমির বিএনপির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, তারা ইতোমধ্যে ৮০ শতাংশ ক্ষমতা দখল করে ফেলেছে।  ভিক্ষুকের থালা থেকে হাটবাজার কিছুই বাকি রাখেনি।’

জামায়াত আমিরের বক্তব্যের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘যাদের জনসমর্থন নেই, তারা এ ধরনের নানা চিন্তাভাবনা করে। আমি কোনো দলের নাম বলছি না। যাদের ভোটে জয়ের সামর্থ্য নেই, তারাই নির্বাচনের বিরুদ্ধে।’


বিএনপির একটি সূত্র দাবি করেছে, আগামী নির্বাচনে জামায়াত এখন ধর্মীয় দলগুলোর সঙ্গে জোট করার চেষ্টা করছে। তারা এই জোটের সঙ্গে একসঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভাপতি বলেন, ‘তাদের (জামায়াত) সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অবশ্যই খুব একটা ভালো নয়। ভালো থাকার কোনো কারণ নেই।" তাদের সঙ্গে আগের অবস্থানে ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই।

স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন। ছাত্র অভ্যুত্থানের পর যে সরকার এখন দেশ শাসন করছে তাদের সময় দেওয়া উচিত। তাই পছন্দের সময় আসুক। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় আছে। আমরা নির্বাচনের জন্য নয়, সরকার সংস্কার ও জনসেবার জন্য কাজ করছি।
জামায়াতের আমির ড. শফিকু রহমান

জামায়াতের দীর্ঘদিনের সঙ্গীর সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করা কেন অসম্ভব তা ব্যাখ্যা করে স্থায়ী কমিটির নেতা বলেন, ৫ আগস্ট থেকে তাদের চেহারা পাল্টে গেছে। এটা এখন বিএনপির সিনিয়র নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছে। দলের নেতা তার বক্তব্যে আরো বলেন, কিছু রাজনৈতিক দল প্রতিবেশী দেশের ফাঁদে পা দিচ্ছে।

জামায়াতের এই নেতা আরও বলেন, আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে বলেন, তখন জামায়াত নেতা বিএনপির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন: ৮০% দখল হয়ে গেছে। এমনকি যদি এখনও ২০% বাকি থাকে। নির্বাচন কেন প্রয়োজন? যা আমাদের শীর্ষ তিন নেতাদের কেউ কেউ ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। তাই দলের মহাসচিব জামায়াতকে পাল্টা জবাব দিয়েছেন।’’

বিএনপির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক: জামায়াত

জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের দাবি, বিএনপির সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক রয়েছে। এটি শুধু বিএনপির সঙ্গে নয়, আন্দোলনে থাকা অন্যান্য বিরোধী দলের সঙ্গেও সুসম্পর্ক ভালো। তাদের দাবি, জামায়াত আমিরের কথার ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাছাড়া জামায়াতকে নিয়ে কে কী বলছে, কার কী প্রতিক্রিয়া- সেসব নিয়ে চিন্তিত নয় দলটি।

জামায়াতে ইসলামের আমির ড. শফিকু রহমান - ছবি সংগৃহীত


জামায়াতে ইসলামীর সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, “বিএনপির সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। শুধু বিএনপির সঙ্গে নয়, যারা আন্দোলনের সহযোগী ছিল তাদের সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।

জামায়াতের আমিরের বক্তৃতার পর বিএনপি মহাসচিবের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে পালওয়াল বলেন: "আমিরের বক্তব্যে ব্যাপক ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।" এর ওপর ভিত্তি করে গণমাধ্যমে অনেকে বক্তব্য ও বিবৃতি দিয়েছেন। কোনটা ভুল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তারা যা করছে তার সাথে জামায়াত বা আমীরের কথার কোন সম্পর্ক নেই।

জামায়াত নির্বাচনের সমস্যার কথা বলে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলিনি। জামায়াত যখন অনেক কথা বলে তখন কিছু কথার জবাব দিতে হয়। তাই জামায়াত আমিরের বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন আমাদের মহাসচিব।তাদের ওপর নির্ভর করছে আগামী নির্বাচনে তারা কীভাবে এবং কার সঙ্গে জোট করবে। তারা যা খুশি তাই করতে পারে, এখানে আমাদের কোনো কিছু বলার নেই।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান

কে কী বলছে তা নিয়ে জামায়াতের কিছু যায় আসে না উল্লেখ করে পরওয়ার বলেন, আমরা জনগণের কাছে যাচ্ছি। রাজনীতিতে জনমত গঠন করা যায় না যতক্ষণ না তা মানুষের হৃদয়ে পৌঁছায়। আমাদের আদর্শ মানব সেবা। এর মানে হল আমি মানুষের কাছে যাই এবং তাদের সমর্থন ও ভালবাসা পাই। এটা কোন ব্যাপার না আপনি এটা কিভাবে নেন,জনগণের সমর্থন ও ভালোবাসা ছাড়া কোনো কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তোলা যায় না।

আপাতত নির্বাচনের চেয়ে রাষ্ট্র সংস্কারে মনোযোগী জামায়াত।

জামায়াতের আমির ড. শফিকুর রহমান বলেন, কেউ বক্তব্য বিকৃত করে অপপ্রচার করলে তাদের কী বলার আছে? বিএনপির সঙ্গে আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে। যদিও চার বছর ধরে জোট সক্রিয় হয়নি। তবে সম্পর্ক ও যোগাযোগের কোনো কমতি নেই।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে জামায়াত অংশগ্রহণের পরিকল্পনা করছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে শফিক রহমান এ কথা বলেন। জবাবে শফিকুর রহমান বলেন, স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। ছাত্র অভ্যুত্থানের পর যে সরকার এখন দেশ শাসন করছে তাদের সময় দেওয়া উচিত। তাই পছন্দের সময় আসুক। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় আছে। এখন আমরা নির্বাচনের স্বার্থে নয়, সরকার সংস্কার ও জনগণের সেবার জন্য কাজ করছি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন